মোটা অঙ্কের মূল্যছাড়ের অফার পেয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মো. নাবিদ রহমান গত মার্চ মাসে দুটি মোটরসাইকেলসহ আরও কিছু পণ্যের জন্য ধামাকা নামের একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মকে সাড়ে ১২ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন।
পরের তিন সপ্তাহের মধ্যে তাকে পণ্যগুলো সরবরাহের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রায় ছয় মাস পার হতে চললেও তিনি এখনও অপেক্ষায় আছেন।
দ্য ডেইলি স্টারকে রহমান বলেন, ‘গত তিন মাসে আমি কয়েকবার ধামাকার অফিসে গিয়েছি। কিন্তু বরাবর সেটি বন্ধ ছিল। আর ফোন করলেও তারা নানা কথা বলে ঘুরাতে থাকে।’
‘শেষ পর্যন্ত, দুই মাস আগে তারা জানায়, আমি দ্রুত আমার পণ্যগুলো বুঝে পাব। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা পাইনি…আমি আর জিনিস চাই না, কেবল আমার টাকা ফেরত চাই।’
একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা ফজলে রাব্বি আগস্টের শেষ দিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়েরের জন্য গিয়েছিলেন। টাকা দিয়েও ই-ভ্যালির কাছ থেকে অর্ডারকৃত পণ্য বুঝে পাননি তিনি।
রাব্বি বলেন, ‘১৭ জানুয়ারি আমি ই-ভ্যালিতে একটি মোটরসাইকেল অর্ডার করি। এটির বাজারমূল্য ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। কিন্তু ই-ভ্যালি এটি ১ লাখ ৭ হাজার টাকায় দেওয়ার অফার দেয়। সে সময় আমি প্রায় ২০ হাজার টাকার মুদি পণ্যের অর্ডারও দেই।’
‘ই-ভ্যালি আমাকে বলেছিল যে, সরকারি ছুটির দিন ছাড়া ৪৫ কর্মদিবসের মধ্যে তারা আমাকে পণ্য বুঝিয়ে দেবে। অথচ আগস্টে এসেও আমি আমার পণ্য পাইনি,’ বলেন রাব্বি।
রাব্বির কাছ থেকে জানা যায়, কোভিড-১৯ মহামারির জন্য গত বছর তিনি তার চাকরি হারান। এখন পাগলের মতো একটা কাজ খুঁজছেন। তিনি আরও বলেন, ‘মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি মোটরসাইকেলটি অর্ডার দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম রাইড শেয়ারিংয়ের কাজ শুরু করব। একটা বেসরকারি হাসপাতালে স্বল্প বেতনে চাকরিরত আমার মায়ের কষ্টার্জিত অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়টি এখন অনিশ্চিত। আমি অসহায় বোধ করছি।’
`পণ্যের জন্য আমি ই-ভ্যালিতে টানা ফোন করেছি। প্রতিবারই আমাকে বলা হয়েছে, আরেকটু অপেক্ষা করুন। জুলাই মাসে তারা আমাকে সিটি ব্যাংকের একটা চেক দেয়। কিন্তু সেটা বাউন্স করে। এর পরপরই চেকটি আর জমা না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ই-ভ্যালি থেকে কয়েকটি কল আসে। কিন্তু তাদের অনুরোধের ধরন ছিল জবরদস্তির মতো।’
‘এখন আমার কী করা উচিত? তাই পণ্য বুঝে পেতে অথবা টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য আমি এখন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে এসেছি,’ বলেন রাব্বি।
রাব্বির মতো এমন ৫ জন ভুক্তভোগী গত রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন তাদের ভোগান্তির কথা জানাতে। ই-ভ্যালির মতোই আরেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জে টাকা জমা দেওয়ার পর কয়েক মাস পার হলেও তারা পণ্য বুঝে পাচ্ছেন না।
এদের মধ্যে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থী আফজাল হোসেন। রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের জন্য একটা মোটরসাইকেল কেনার পরিকল্পনা ছিল তার।
আফজাল জানান, ই-অরেঞ্জে তিনি যে মোটরসাইকেলটির অর্ডার করেছিলেন তার বাজারমূল্য ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার ৪০০টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এটি ৫০ শতাংশ ছাড়ে দেওয়ার অফার করেছিল।
এর পাশাপাশি বড় বোনের কাছ থেকে ৬৫ হাজার টাকা ধার করে আফজাল আরও কিছু পণ্যের অর্ডার দিয়েছিলেন।
ভুক্তভোগী ৫ ব্যক্তি ডেইলি স্টারকে জানান, তারা হয় পণ্য চান। নয়তো টাকা ফেরত চান। একইসঙ্গে তারা তাদের এই ভোগান্তির অবসানের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
কেবল গ্রাহকরা নন, এই ধরনের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া পণ্যের বিপরীতে শত শত ব্যবসায়ীও তাদের পাওনা টাকা বুঝে পাননি।
ফলে দুই পক্ষ মিলিয়ে হাজারো ভুক্তভোগীর ওপর হতাশা নেমে এসেছে। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকৃত অর্থ তারা আদৌ ফেরত পাবেন কিনা- সে ব্যাপারে অনিশ্চয়তা তীব্র হয়ে উঠেছে। অনুমান করা হচ্ছে, এর মোট পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সরকারি তদন্তের আওতাধীন এমন ডজনখানেকের বেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মূলত ই-ভ্যালি, ধামাকা ও ই-অরেঞ্জই বেশিরভাগ গ্রাহকের ভোগান্তির জন্য দায়ী। যাদের কারও কাছ থেকেই বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ধামাকায় বিনিয়োগ করা পণ্য সরবরাহকারী ব্যবসায়ীরা তাদের ২০০ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চেয়েছেন।
গত ১৬ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে লেখা এক চিঠিতে ধামাকার সরবরাহকারীরা জানান, গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে পাওনা পরিশোধ করার কথা ছিল ধামাকার। কিন্তু ১৫০ কর্মদিবস পেরিয়ে গেলেও ৬৫০ জন ব্যবসায়ী এখনও পাওনার অপেক্ষায় আছেন।
চিঠিতে বলা হয়, ধামাকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসিমউদ্দীন চিশতী এই মুহূর্তে দেশের বাইরে আছেন। গত ১৩ জুলাই তিনি পাওনা পরিশোধের কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা পরিশোধ করা হয়নি।
এই ব্যবসায়ীরা সবাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তা। তাই তাদের বিষয়টি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ও মানবিক বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
চিঠিতে ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের সব হারিয়েছি। এখন ব্যাংক ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে আমাদের প্রচুর ঋণ। ধামাকার সঙ্গে ব্যবসা করতে গিয়ে আমরা পথের ফকিরে পরিণত হয়েছি।’
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, গ্রাহকরা ধামাকার কাছে ঠিক কত টাকা পাবে, তা পরিষ্কার না। কারণ সম্পদ ও দায়ের রেকর্ড চেয়ে মন্ত্রণালয় যে নোটিশ দিয়েছিল, প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত তার জবাব দেয়নি।
যদিও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তথ্য অনুসারে, ব্যাপক মূল্যছাড়ের বিভিন্ন অফার দিয়ে আকৃষ্ট করে ধামাকা প্রায় ৫ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ৮০৩ কোটি টাকার বেশি অগ্রিম নিয়েছে।
সিআইডির আর্থিক অপরাধ বিভাগের পুলিশ সুপার মো. হুমায়ুন কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সম্ভবত এই পরিমাণ আরও বেশি…অন্য লেনদেনগুলো খুঁজে বের করার ব্যাপারে আমরা এখনও কাজ করছি।’
গত সপ্তাহে সিআইডি চিশতীসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ১১৬ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে বনানী থানায় একটি মামলা দায়ের করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত সব ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম একই পথ অনুসরণ করেছে।
প্রথম দিকে তারা অগ্রিম অর্থ নিয়ে মোটা অঙ্কের মূল্য ছাড়ের পণ্য সরবরাহ করে। কয়েক মাস বাদে যখন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গ্রাহক এতে আকৃষ্ট হয়, তখন তারা পণ্যও দেয়নি, টাকাও ফেরত দেয়নি।
চলমান মহামারি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য একটা আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যার বিপরীতে এমন একটি বিতর্কিত বাণিজ্যিক মডেল দাঁড়িয়েছে।
যার শুরুটা হয় ই-ভ্যালির মাধ্যমে। এটা ছিল অনেকটা হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। ২০১৮ সালের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠার পর চমকপ্রদ ক্যাশ ব্যাক ও মোটা অঙ্কের ছাড়ের অফার দিয়ে ই-ভ্যালি প্রচুর সংখ্যক গ্রাহক আকৃষ্ট করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ইভ্যালি গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের পাওনা পরিশোধ করতে সক্ষম নাও হতে পারে।
বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এ ধরনের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, প্রতিযোগিতার নিয়ম ভঙ্গ ও অর্থ পাচারের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে।
গত মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে ইভ্যালি জানায়, মধ্য জুলাই পর্যন্ত গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের মোট দায় ছিল ৫৪৩ কোটি টাকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া পরিমাণের চেয়ে যা ৩৫ শতাংশ বেশি।
এদিকে মূল্য ছাড়ের অফারগুলোতে উৎসাহিত হয়ে অনেক গ্রাহক আবার বিনিয়োগকারীতে পরিণত হয়েছেন। ই-কমার্স প্লাটফর্মগুলো থেকে পণ্য কিনে যারা সেগুলো লাভে বিক্রি করেন।
কিন্তু সবার পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থী অদ্বিত হোসেন ৭টি মোটরসাইকেল ও কিছু গিফট ভাউচারের জন্য গত মে মাসে ই-অরেঞ্জে প্রায় ১৪ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন।
অদ্বিত বলেন, ‘তারা (ই-অরেঞ্জ) ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ৩ মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আমি তা পাইনি।’
ই-অরেঞ্জকে অগ্রিম অর্থ পরিশোধের জন্য অদ্বিত তার নিজের মোটরসাইকেলটি বিক্রি করে দেন। ৩ লাখ টাকা ধার করেন বাবার কাছ থেকে। আর বাকি টাকাটা জোগাড় করেন এক আত্মীয়ের কাছ থেকে। এই শর্তে যে, ই-অরেঞ্জ থেকে মোটরসাইকেলগুলো পাওয়ার পর সেগুলো পুনরায় বিক্রি করে লাভের টাকা তারা ভাগাভাগি করে নেবেন।
অদ্বিত বলেন, ‘এখন তারা আমার ফোন ধরছে না। জানি না, আমার কপালে কী আছে?’
গত ১৬ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন মো. তাহেরুল ইসলাম নামের একজন গ্রাহক।
মামলার বিবৃতিতে অভিযোগকারী বলেন, গত ২৮ এপ্রিল অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তার পণ্যগুলো সরবরাহ করা হয়নি।
পরের দিন এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির সাবেক দুই মালিক ঢাকার একটি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে আদালত তাদের জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠান।
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম জানান, মামলার তদন্ত চলছে এবং তারা প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
আলাদীনের প্রদীপ নামের একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের একজন কর্মকর্তার বক্তব্য, প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ১৭ হাজার অর্ডারের টাকা ফেরত দিয়েছে। এমন আরও ৮ হাজারের মতো অর্ডার বাকি আছে।
সিরাজগঞ্জ শপ নামের এমন আরেকটি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা জানান, তারা এ পর্যন্ত ৯৫ হাজার অর্ডারের অগ্রিম টাকা গ্রাহককে ফেরত দিয়েছেন। ৭ হাজারের বেশি অর্ডার এখনো বাকি আছে।