ইতিহাস কখনো কাউকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে না। আবার যার যা প্রাপ্য তা বুঝিয়ে দিতেও বিলম্ব করে না। অনেক সময় আমরা ভাবি ইতিহাস তো অতীত। হয়তো এসব সেকালে ঘটত, যা এখন আর ঘটে না। এক সময়ে আমরা শুনেছি, বখতিয়ার খিলজির মুখোমুখি হবার বদলে বাংলার শাসক লক্ষণ সেনের পালানোর কথা। শ্রুতি আছে, মাত্র ১৭ জন সৈন্যের বাহিনীসহ খিলজীকে না দেখে, না জেনেই পালিয়েছিলেন সেন বাবু। আমরা এটাও জানি, সিরাজউদ্দৌলা একটি বিতর্কিত চরিত্র। বাংলা বলতেনও না অথচ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব নামে খ্যাত তিনিই হয়ে গেলেন বাংলা নাটক ও মনোজগতের এক বিশাল দেশপ্রেমিক চরিত্র। এসব কথা বলছি এই কারণে যে, বোঝা মুশকিল ইতিহাস বা সময় আসলে কাকে, কখন, কোথায় দাঁড় করায়।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন মৃতপ্রায়। কোথাও কোনো রাজনৈতিক কাজকর্ম কিংবা রাজনীতির কোনো দাপট নেই। এর কারণ বিবিধ। আমার মতে প্রধানতম কারণটি হচ্ছে উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন। উন্নয়ন বা অবস্থার উন্নতি ঘটায় বাঙালি ঝুট-ঝামেলায় যেতে নারাজ। আজকে খাবারের নিরাপত্তা বা থাকার বন্দোবস্ত কোনো না কোনোভাবে হয়ে যায় বলেই তাদের আগ্রহ নেই রাজনীতিতে। আর আজকের প্রজন্ম ডিজিটাল দুনিয়ার কারণে বুঝে গেছে লাইফ ইজ সামথিং ইমপরট্যান্ট। আগের কালের মতো কথায় কথায় জীবন দানের কথা সে স্বপ্নেও ভাবে না।
কথাগুলো বললাম এই কারণে যে, রাজনীতি না থাকলেও হানাহানি বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়নি পরস্পরকে ছোট বা হেয় করার অপরাজনীতিও। এসব ঘটনা ঘুরেফিরে শেষ বা শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের বছরে গিয়ে। সে সময়কার কারো ভূমিকাই আমরা অবিতর্কিত রাখতে পারিনি। বরং সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। সেটাও বলছি না, বলছি এখনকার একমুখী রাজনীতিতে সকলে মিলে স্তাবকতা আর তোষামোদিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। ইতিহাসের আসল সত্য বা তার পাঠ কেউ মনে রাখে না। তাই, যখন যে দেশশাসনে তার স্তুতিতে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙালির অভাব হয় না। এখন যেন তারই প্লাবন বইছে দেশে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রতি এদের যে তথাকথিত আনুগত্য ও স্তাবকতা তাতে অতীত এসে হানা দেয় মনে। একমাত্র বঙ্গবন্ধু ও তার চার সহযোদ্ধা ছাড়া সবাইকে কাবু করেছিল এই স্তাবকের দল। বঙ্গবন্ধুকে কাবু না করলেও বিভ্রান্ত করে দেশ ও তার সর্বনাশ করতে পিছপা হয়নি তারা। এরাই হত্যা করেছিল তাকে সপরিবারে।
এরপর আমরা জিয়াউর রহমান থেকে এরশাদ অতঃপর খালেদা জিয়া সর্বত্র সে একই বাস্তবতা দেখেছিলাম। বিশেষত এরশাদের আমলে কত ধরনের যে ভণ্ডামি আর মোসাহেবী দেখেছি। প্রয়াত কাজী জাফর আর মওদুদ আহমেদের ভেতর একটা নীরব প্রতিযোগিতা কাজ করত কে কার থেকে বেশি চাটুকারিতা করতে পারেন। অথচ সময়ের ব্যবধানে এরশাদ পতনের পরপরই সেই কাজী জাফর হয়ে উঠেছিলেন বিএনপির শরীক আর মওদুদ সাহেব তো মন্ত্রী। এর কারণ মূলত দুটো। একটা ছিল আওয়ামী বিরোধিতা, আর অন্যটি হলো যেনতেন প্রকারে গদী লাভ। এরা কারো বন্ধু ছিলেন না। আজকে তেমনি আমরা নেতাদের ভীড়ে সরকারি দলের নৌকা ভরে উঠতে দেখছি। যেদিকে তাকাই হাইব্রিড আওয়ামী নেতা লীগের সমর্থক।
একসময় সভা-সমাবেশ করাও ছিল অসম্ভব। সে দুঃসময়ে যারা কাছে ছিল তারা আজ পরিত্যক্ত। কিন্তু ভয়ের মূল জায়গাটা অন্যত্র। একদা বামপন্থী বা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট কবি, সাংবাদিক, লেখকরাও দেখলাম সম্পূর্ণ ভোল পাল্টে লীগ তো বটেই বঙ্গবন্ধু পরিবার নিয়েও তোষামোদিতে নেমেছেন। ইতোমধ্যে পুরস্কারও জুটে গেছে কারো কারো। কিন্তু খায়েশের শেষ নাই। শেষ নাই চাওয়া-পাওয়ার। যত পাই তত চাইয়ের এই সমাজে তারা আরো চায়। তা তারা চাইতেই পারে। ডান-বাম, জামায়াত-হেফাজত সবাই চায়। আর সরকারি দল দিতেও কসুর করে না। অথচ যে সর্বনাশ বাসা বাঁধছে তার দিকে খেয়াল নেই কারো। এরশাদ যখন যেখানে যেতেন কাউকে না কাউকে কিছু না কিছু দিতেন। তেমনি এক ভদ্রলোক যিনি নাকি এরশাদের ভাগ্য গণণার নামে হঠাৎ নেতা হয়ে গিয়েছিলেন সে জ্যোতিষীর দাপট দেখে যেমনি অবাক হতাম তেমনি বিস্মিত হয়েছি এরশাদ পতনের পর তাদের ভূমিকায়। অবশ্য এ আর নতুন কী? এই দেশেই মোশতাকের জন্ম হয়েছিল। মীরজাফর এ দেশেরই মানুষ ছিল।
দমবন্ধ করা পরিবেশে দালালেরা কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা ছিল ভিন্ন। ইতিহাসের পাঠ থেকে কিছু শিখবে এটাই ভেবেছিলাম আমরা। এরশাদ আমলে তার প্রেমে পড়া নারীদের তালিকা দেখলে বিশ্বসেরা প্রেমিকেরও মাথা খারাপ হবার কথা। রমনীমোহন এরশাদের পতনের পর বা তার মৃত্যুর পর এদের কাউকে আহাজারী করতে শুনেছেন? দেখেছেন কাউকে বাইরে এসে কিছু বলতে? তার যে দুই স্ত্রীর লড়াই তাও কিন্তু ভোগ দখল নিয়ে। এসব দেখার পরও চোখ বন্ধ করে কী করে ভাবি আমরা নিরাপদ? আওয়ামী লীগের পরাজয় বা তাদের সর্বনাশে বড় মাঝারি নেতাদের কখনো কিছু হয়নি। হয়ও না। তারা ম্যানেজ করতে জানেন। ম্যানেজ করাও আছে সবকিছু। সমস্যা হয় সাধারণ প্রগতিশীল আর সংখ্যালঘুদের। তাদের ঘরবাড়ি যায়, সম্পত্তি যায়। আর বড় নেতারা তখন থাকেন কানাডা-আমেরিকার মতো দেশে। যে পরিবারের সর্বস্ব একরাতে উজাড় হয়ে যায়। যাদের জীবনে মা-বাবা ভাই বা আত্মীয়দের চলে যাবার আলাদা আলাদা দিন থাকে না তাদের পাশে তখন কেউই দাঁড়ায় না। কারণ এরা সুখের পাখি। বসন্তের কোকিল।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশ এমনই এখানে সাদা-কালো, ভালো-মন্দ সব মিলেমিশে একাকার। এই ডিজিটাল যুগে রাস্তায় তো বটেই বাড়িতেও পাশে থাকার কেউ নাই। সবাই যার যার ধান্দা আর মস্তিতে মশগুল। মাঝে মাঝে মনে হয় কী লাভ এসব লিখে? যারা টাকা বানানোর তারা তা বানিয়ে নিয়েছে। যাদের যা যা দরকার বাগিয়ে এখন কবে ভাগবেন সে আশায় দিন গুনছে। বাকী যে সাধারণ মানুষ তাদের কাছে এও যা, সেও তা। তবু আশা ভরসা আর সম্ভাবনার দেশ ও মানুষের জন্য মায়া হয়। সমাজে এত মোশতাক, এত দালাল আর সুবিধাবাদী মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখাও যেন ভয়ের ব্যাপার।
বারবার ঘুরে দাঁড়ানো এই দেশের সর্বনাশ করেছে অপরাজনীতি। এবার যদি কিছু ঘটে তা করবে নো রাজনীতি। এই নো রাজনীতি আর স্তাবকতার উদ্দেশ্য দু-একটা পদক পুরস্কার আর টাকা। নেপথ্যে ভোগ। নারী আর অর্থ সম্পদের প্রতি এমন লোভ না আগে কেউ দেখেছে, না দেখবে। এর সাথে উন্নয়নের নামে চলছে পোশাক শ্রমিক আর রেমিট্যান্স পাঠানো মানুষ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। বাকি যে বুদ্ধিবৃত্তি সে আজ রসাতলে।
কে দেখাবেন পথ? কোথায় দেশের উদ্ধার?