এখন এই সবগুলো দেশ চীনকে সদস্য করে নিতে হয়তো একযোগে সম্মত নাও হতে পারে। কারণ এখানে চীনের যোগ দেওয়া মানে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের পথ সুগম হওয়া। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন চীন সদস্য হিসেবে যোগ দিতে পারুক বা না পারুক তাদের এই আবেদন জমা দেওয়ার পদক্ষেপ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন অর্থনৈতিক নীতির যে ঘাটতি রয়েছে তাই তুলে ধরেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশ্লেষকেরা বলেছেন, কিছু সদস্য দেশের সঙ্গে বেইজিংয়ের কূটনৈতিক সম্পর্ক এখানে তার সদস্যপদ পাওয়ার সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তারা আরও বলেছে, বাণিজ্য চুক্তির অনেক দাবি পূরণের ক্ষেত্রে চীন সম্ভবত সমস্যার সম্মুখীন হবে। সিপিটিপিপিতে যোগদানের জন্য চীনের মতো যুক্তরাজ্য ও তাইওয়ানও আবেদন করেছে।
চীনের সামনে যে বাধা
সিপিটিপিপিতে মার্কিন মিত্র যেমন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং জাপান ক্রমশ চীনকে ‘কৌশলগত হুমকি’ হিসেবে দেখছে। রিস্ক কনসালটেন্সি ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষকেরা বলছেন, তারা চীনের আবেদন আটকে দিতে পারে। বেইজিংকে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক পুনর্নির্মাণের জন্য অনেক বিষয়ে বড় ছাড় দিতে হবে। চীনা নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না হলে এই তিনটি দেশের সম্মতি পাওয়া যাবে না। এর মধ্যে জাপানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর হওয়ার দৌড়ের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সিপিটিপিপি মান পূরণ করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বলে জানা গেছে। অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী ড্যান তেহানও বলেছেন, যে দেশ এই বাণিজ্য চুক্তিতে যোগ দিতে চায় তাকে ‘সব নিয়ম ও মান মেনে চলতে হবে।’
পূর্ব চীন সাগরে চীনের সঙ্গে জাপানের একটি বিদ্যমান আঞ্চলিক বিরোধ রয়েছে। এ ছাড়া চীন কর্তৃক আরোপিত আমদানির শুল্কের ঝামেলায় আছে অস্ট্রেলিয়া। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তি বা ইউএসএমসিএর মাধ্যমে কানাডা এবং মেক্সিকো চীনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইউএসএমসিএ ট্রাম্প প্রশাসনের সময় উত্তর আমেরিকান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা নাফটাকে প্রতিস্থাপন করে হয়েছিল।
রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও, সীমান্তের তথ্য প্রবাহ, শ্রম এবং পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ নানা ধরনের বিষয় সিপিটিপিপি শর্ত পূরণ করা চীনের জন্য কঠিন হতে পারে। ব্যবসায় চীনের অনুপযুক্ত বাণিজ্য অনুশীলন, যেমন রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে ভর্তুকি দেওয়া, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সুরক্ষার অভাব এবং জোরপূর্বক প্রযুক্তি হস্তান্তরের অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে।
চীনের ‘স্মার্ট কূটনীতি’
তবে চীন সদস্য হতে পারুক বা না পারুক, বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, চীনের সিপিটিপিপিতে যোগ দিতে চাওয়ার আবেদন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দেশটির সম্প্রসারিত অর্থনৈতিক প্রভাবকে তুলে ধরেছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ইস্যুতে ব্যাপকভাবে মনোনিবেশ করেছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সম্প্রতি একটি চুক্তি হয়েছে। এইউকেইউএস নামের এই চুক্তির অধীনে অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিনের প্রযুক্তি সরবরাহ করবে ওই দুই দেশ। আর এ অবস্থায় এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করেছে চীন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য এটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তবে তার প্রশাসন বাণিজ্য নীতি প্রণয়ন করেনি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিপিটিপিতে যোগদানের সম্ভাবনাও কম। তবে চীন যা করেছে তা হলো, সে ইতিমধ্যে এই অঞ্চলের অনেক দেশের জন্য একটি প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে। গত বছর ১৪টি অন্য আঞ্চলিক অর্থনীতির সঙ্গে জোট বেধে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) নামে নতুন জোটে সাক্ষর করেছে চীন। এই জোটের অর্থনীতির আয়তন বিশ্বের মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ। ফলে, এই চুক্তি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবাধ বাণিজ্য এলাকা তৈরি করবে। যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা এবং মেক্সিকোর মধ্যে যে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল রয়েছে সেটি বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়েও এশিয়ার নতুন এই বাণিজ্য অঞ্চলটির পরিধি বড় হবে। আবার সিপিটিপিপিতে সদস্য হওয়ার আবেদনও করেছে। অর্থাৎ একটি বিষয় যা স্পষ্ট তা হলো, এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে চীন অনেকটা পথই এগিয়ে গেছে।