বিদেশি শনাক্তকরণে গঠিত আদালত (ট্রাইব্যুনাল) এখন থেকে বিচারের ‘ফলাফলস্বরূপ নির্দেশ বা আদেশ’ (রায়) দিতে পারবেন না বলে জানিয়েছে ভারতের আসাম রাজ্যের সরকার।
কোনো ব্যক্তি ভারতীয় কি না, তা নিয়ে শুধু সরকারকে মতামত দেওয়ার মধ্যে বিদেশি শনাক্তকরণে গঠিত আদালতের এখতিয়ার সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা বিচারপতিদের মতো রায় দেওয়া শুরু করেছিলেন। এটি তাদের এখতিয়ারভুক্ত নয় বলে ৪ সেপ্টেম্বর জানিয়েছে আসামের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজনৈতিক দপ্তর।
সরকারের এমন নির্দেশনার কারণ ট্রাইব্যুনাল একটি আধা-বিচারব্যবস্থা, পূর্ণাঙ্গ আদালত নয়। কিছু সুপারিশ করার অধিকার ট্রাইব্যুনালের রয়েছে, কিন্তু শাস্তিদানের অধিকার নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশিকা এ সপ্তাহে প্রকাশ্যে এসেছে। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।
ভারতে ১৯৪৬ সালে পাস হওয়া বিদেশি চিহ্নিতকরণ আইনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারা ব্যবহার করে ১৯৬৪ সালে বিদেশি শনাক্তকরণ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল। নথিপত্র খতিয়ে দেখে এই ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব ছিল সরকারকে জানানো, কে বিদেশি বা কে নয়। কিন্তু আসামে ২০১৫ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর নাগরিক নথিভুক্তিকরণ (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস) প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা অনেকটা বেড়ে যায়। ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা তাঁদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেন কে নাগরিক আর কে নন।অনেককে গ্রেপ্তার করে অস্থায়ী বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়। বেশ কিছু মানুষকে গ্রেপ্তার করে রাতারাতি বাংলাদেশে পাঠানোর নির্দেশও ট্রাইব্যুনাল দেয় বলে আসামের গণমাধ্যম জানিয়েছে। অনেককে ‘সন্দেহভাজন’ চিহ্নিত করে আবার ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেন এই আধা-বিচারকেরা। স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, এই অপরিসীম ক্ষমতা কোনো সাংবিধানিক নিয়মনীতি মেনে ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের দেওয়া হয়নি।
‘ফলে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা নির্দেশ দিতে থাকেন। এর ফলে দুর্নীতি বাড়ে। ইচ্ছেমতো কাউকে বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে টাকা নেওয়া হয়েছে এবং টাকা নিয়ে তারপর আবার ভারতীয় বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। এ রকম ঘটনা হিন্দু–মুসলমান সব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। আমি এ রকম অসংখ্য ঘটনার কথা জানি’, প্রথম আলোকে বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বরাক উপত্যকার এক আইনজীবী।
আসামের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজনৈতিক দপ্তর এখন বলেছে, এসব নির্দেশ দেওয়া থেকে ট্রাইব্যুনালকে বিরত থাকতে হবে। ‘ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলে একটি জরিপের মাধ্যমে বিচার বিভাগ জানতে পেরেছে, তাঁদের মতামত দিতে গিয়ে (বিচারের) ফলস্বরূপ
নির্দেশ/আদেশ দিচ্ছেন ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা…ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া, গ্রেপ্তার করা বা বিদেশি ঘোষণা করে বন্দী রাখার নির্দেশ (ট্রাইব্যুনালের তরফে) দেওয়া হয়েছে। এর কোনো প্রয়োজন নেই’, নির্দেশিকায় লিখেছেন রাজনৈতিক বিভাগের উপসচিব পারিজাত ভূঁইয়া।
উপসচিবের নির্দেশে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বিচারের ‘ফলস্বরূপ বিদেশি চিহ্নিত করে অন্যত্র ফেরত পাঠানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এটাও সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।’
আসামের মানুষের একটা বড় অংশ এই নির্দেশকে স্বাগত জানিয়েছেন। সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই নির্দেশের ফলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কমবে।
আশা করা যায়, সরকারের এই নির্দেশিকার পর আসামে ইচ্ছেমতো মানুষকে বাংলাদেশি চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা বা হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে মানুষকে অস্থায়ী বন্দিশিবিরে আটকে রাখার ঘটনা বন্ধ হবে।